ডিজিটাল ডেস্ক, ৩ মে: গত ১৪ বছর ধরে দেশে কোনও জনগণনা হয়নি। শেষবার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল ২০১১ সালে। নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী জনগণনা হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে, তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। এরই মাঝে বুধবার কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎই একটি বড় ঘোষণা করে—এবারের জনগণনার সঙ্গে সঙ্গেই হবে জাতগণনা বা কাস্ট সেনসাস। বহুদিন ধরেই এই দাবি তুলে আসছিলেন রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, এমকে স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদবের মতো বিরোধী নেতারা। এবার তাদের সেই দাবিতেই কার্যত সিলমোহর দিল কেন্দ্র।
বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির বৈঠকের পর বড় ঘোষণা আসে কেন্দ্রের তরফে। বৈঠক শেষে রেল ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, এবার একসঙ্গেই হবে দেশের জনগণনা এবং জাতগণনা (কাস্ট সেনসাস)। তবে এই প্রক্রিয়া ঠিক কবে শুরু হবে, সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা জানাননি তিনি। এর পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে জোর জল্পনা—আসন্ন ভোটমুখী রাজ্যগুলির কথা মাথায় রেখেই কি এই সিদ্ধান্ত? বিশেষ করে, জাতগণনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (OBC), যা পশ্চিমবঙ্গ-সহ বহু রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাতেও ওবিসি-র সংখ্যা অল্প নয়। পাশাপাশি এমন বহু পদবির মানুষ রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন তাঁরাও ওবিসির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য, এবং সেই দাবিও বারবার জোরালো হয়েছে। বারংবার আলোচনায় উঠে আসে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশের প্রসঙ্গও।
রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত মহলের অনেকেই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশের সময় মমতা ঘোষণা করেছিলেন, মাহিষ্য, তিলি, তামুল এবং সাহা সম্প্রদায়কে ওবিসি তালিকাভুক্ত করার জন্য তাঁর সরকার উদ্যোগ নেবে। পরে ক্ষমতায় ফিরে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে এগিয়েও যান তিনি—প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব রাজ্য মন্ত্রিসভায় পাশ করান।
তবে বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি, কারণ ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারেরও অনুমোদন প্রয়োজন। ফলে পুরো প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি।
‘পদ্ধতিগত ত্রুটি’-র অভিযোগে সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্ট প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করে দেয়। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। সেখানে রাজ্যের তরফে নতুন করে ওবিসি সংক্রান্ত সমীক্ষা চালানোর জন্য তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে। এই মামলার পরবর্তী শুনানি নির্ধারিত হয়েছে আগামী জুলাই মাসে।
এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জাতগণনার ঘোষণা রাজ্যের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস বিষয়টিকে কোনও চাপ হিসেবে মেনে নিচ্ছে না। বরং শাসকদলের ব্যাখ্যা, জাতগণনার সিদ্ধান্ত আসলে আসন্ন ভোটকে মাথায় রেখে কেন্দ্রের একটি কৌশল—এক ধরনের ‘ভোটের অস্ত্র’ হিসেবেই তারা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছে ও প্রচারে ব্যবহার করছে।
বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক সমীকরণে জাতগণনা নিয়ে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত নতুনভাবে উসকে দিতে পারে রাজনীতি। এই প্রেক্ষাপটে বিজেপি ও তৃণমূল উভয়েই ভিন্ন কৌশলে জাতগণনাকে ‘হাতিয়ার’ করতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
গত লোকসভা ভোটে মতুয়া ও রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকায় বিজেপি শক্ত অবস্থানে ছিল, যদিও কোচবিহার আসন হারিয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে—যেমন ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া—পূর্বে বিজেপির যে প্রভাব ছিল, তা ভেঙে দিয়েছে তৃণমূল। এই এলাকা থেকে আসন ছিনিয়ে নিয়েছে জোড়াফুল শিবির।
এমন প্রেক্ষাপটে, কেন্দ্রের জাতগণনার সিদ্ধান্তকে সামনে রেখে বিজেপি ওবিসি ও অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে চাইবে। অন্যদিকে, তৃণমূল একে বিরোধীদের দীর্ঘদিনের দাবি বলে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। আর যদি ঘোষণার পরও প্রকৃত প্রক্রিয়া শুরু না হয়, তাহলে তৃণমূলের সামনে সুযোগ তৈরি হবে জাতগণনাকে ‘আরও একটি জুমলা’ বলে প্রচারে আক্রমণ শানানোর।
বিহারে যখন নীতীশ কুমার আরজেডির সঙ্গে জোটে সরকার চালাচ্ছিলেন, তখনই রাজ্যে জাতিগত সমীক্ষা চালানো হয়। এরপর তামিলনাড়ু ও কর্নাটকেও একই ধরনের সমীক্ষা হয়েছে। এই সব সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, ওবিসি সম্প্রদায় সম্পর্কে সরকারের কাছে নির্ভরযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ঠিক এই অভাবই জাতিগত তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে এবং সারা দেশে সমগ্র জনগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে সমীক্ষা চালানোর দাবি ধীরে ধীরে আরও জোরালো হয়ে ওঠে।
Comments are closed.