Digha Rath Yatra 2025 : দিঘায় প্রথমবারের জন্য জগন্নাথের রথ গড়াল কীর্তনের তালে, কাঁসর হাতে মুখ্যমন্ত্রী, ভক্তদের বাঁধভাঙা উল্লাস

19

ডিজিটাল ডেস্ক, ২৭ জুন : সাগরের গর্জন, আলোকসজ্জার রঙিন ঝলকানি, কীর্তনের তালে হৃদয় মাতানো সুর আর চন্দনের সুবাসে শুক্রবার এক অনন্য ঐতিহাসিক মুহূর্তে মোহিত হল দিঘা (Digha Rath Yatra 2025)। প্রথমবারের মতো সমুদ্রতটে আয়োজন করা হল জগন্নাথদেবের মহারথযাত্রা। যে রথযাত্রার টান বছরে বছর ভক্তদের টেনে নিয়ে যায় পুরীর পথে, এবার সেই পবিত্র অভিজ্ঞতার ছোঁয়া মিলল পশ্চিমবঙ্গের এই জনপ্রিয় সৈকত শহরে। উৎসবের আবহে দিঘা যেন এক নতুন রূপে ধরা দিল—গলিগলি মুখরিত কীর্তনের ধ্বনিতে, এক ঐতিহ্যবাহী আবেগে পরিপূর্ণ।

সমুদ্র শহর দিঘার বুকে প্রথমবারের মতো এগোল দেবত্রয়ীর রথ। কাঠের নির্মিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি সজ্জিত হল যথাক্রমে ‘নন্দীঘোষ’, ‘তালধ্বজ’ ও ‘দর্পদলন’ নামক রথে। ঐতিহ্যবাহী ‘পাহান্ডি বিজয়’-এর মাধ্যমে তাঁরা যাত্রা শুরু করলেন মাসির বাড়ির উদ্দেশে—এক চিরন্তন আচার, যা এবার সমুদ্রের গর্জনের মাঝে ধরা দিল এক নতুন আবহে।

ভোর থেকে দিঘার পথে ভক্তদের ঢল, সৈকতজুড়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ—প্রথমবারের মতো আয়োজিত রথযাত্রা দেখতে জমজমাট শহর। দেশ-বিদেশ থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সমুদ্রতট। ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলে কৃষ্ণভক্তির আনন্দে মেতে উঠেছেন, মিলেছে এক অপূর্ব একাত্মতা। ইসকনের সদস্য থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত ভক্তরা একত্রিত হয়েছেন এই ঐতিহাসিক আয়োজনে। ভাষা, জাতি, দেশের সব সীমানা যেন মিলিয়ে গেছে খোল-করতালের ছন্দে, পা মেলানো নৃত্যে আর একসাথে কীর্তনে। রঙিন পোশাকে, উজ্জ্বল মুখে, নারী-পুরুষ সকলের মিলিত উপস্থিতিতে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে দিঘা শহর—একটি সত্যিকারের ভক্তিময় মিলনমেলা।

এই বছরের শুরুতেই দিঘার বুকে নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন ঘটেছে, আর সেই আনন্দের ধারাবাহিকতায় এবারই প্রথম পালিত হল রথ উৎসব। বহুদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এদিনের জন্য অধীর আগ্রহে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকরাও। সকাল ৯টা বাজতেই শুরু হয় পুজোর আনুষ্ঠানিকতা—এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে।

মন্দির প্রাঙ্গণে সারিবদ্ধভাবে সাজানো ছিল তিনটি রথ—প্রথমে বলরামের, তারপরে সুভদ্রা, আর সবশেষে মহাপ্রভু জগন্নাথের রথ। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই প্রতিটি দেবতাকে পুজো করা হয়। এই মহোৎসবে নিজে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর উপস্থিতি উৎসবকে আরও গৌরবময় করে তোলে। পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর, প্রথা অনুসারে পুরোহিতরা আনন্দঘন পরিবেশে নৃত্য করে কাঁধে করে জগন্নাথদেবকে রথে তুলে আনেন। তখন রথটি একখানি শাড়ির আচ্ছাদনে ঢাকা ছিল, যা আরতির পরে সরিয়ে দেওয়া হয়। দুপুর ২টোর সময় মুখ্যমন্ত্রী নিজ হাতে প্রভুর আরতি করেন এবং ঠিক ২:৩০ মিনিটে রথ যাত্রা শুরু করে মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের ‘মাসির বাড়ি’-র পথে। এক ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম যেন ঘটল দিঘার বুকে।

মুখ্যমন্ত্রী নিজে অংশ নিয়েছেন রথের সামনে আয়োজিত বিশেষ আরতিতে। এরপর তিনি হাতে তুলে নেন সোনার ঝাড়ু, দেবতার যাত্রাপথ নিজে ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেছেন তিনি।

ভক্তরা যেন রথের রশিতে টান দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের তরফে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পদক্ষেপ। রথযাত্রার পথে দুই পাশে বসানো হয়েছে শক্তপোক্ত ব্যারিকেড। যাঁরা টান দিতে চান, তাঁদের জন্য রাখা হয়েছে সুনির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত পথ। ভিড় সামাল দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনী। গোটা দিঘা শহর ঘিরে ফেলা হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে, যাতে এই ঐতিহাসিক উৎসব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে অনুশাসনও বজায় রেখে, রথযাত্রা উৎসব রাঙিয়ে তুলেছে এক অভূতপূর্ব ভক্তিময় পরিবেশে।

বৃষ্টির বাধা উপেক্ষা করে অবিরাম ভক্তস্রোতে মুখর দিঘা। কীর্তনের ধ্বনি, ঢাকের গর্জন আর রঙিন পতাকায় সেজে ওঠা শহরের প্রতিটি কোণ যেন জেগে উঠেছে এক মহোৎসবের আমেজে। মনে হচ্ছে, সমুদ্রতীরবর্তী এই স্থান নিজেই ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে এক নতুন ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্রে—যেখানে প্রকৃতির ঢেউ আর আধ্যাত্মিকতার প্রবাহ একসূত্রে মিশে গেছে।