ডিজিটাল ডেস্ক ১২ই জুলাইঃ আমেদাবাদ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে শিহরিত হওয়ার মতো তথ্য উঠে আসছে সর্বসমক্ষে। ‘এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’১৫ পাতার একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। তাতে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে টেকঅফের পরেই বিমানের দুটি ইঞ্জিনের একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা(Ahamedabad Air Crash Report)।
AAIB-এর রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে শোনা গিয়েছে,একজন পাইলট টেকঅফের পরেই অন্যজন পাইলটকে জিজ্ঞেস করছেন,‘তুমি কেন ফুয়েল বন্ধ করে দিলে?’ অপর পাইলট জবাবে বলেন,‘আমি ফুয়েল বন্ধ করিনি। আমি কিছু করিনি।’ ১২ই জুন লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮-এ আসলে কী সমস্যা হয়েছিল তার মূল চাবিকাঠি লুকিয়ে এই কথাগুলির মধ্যেই। AAIB-এর পেশ করা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমানটি টেকঅফের পর স্পিড নিতে শুরু করতেই আচমকা ইঞ্জিন ১ এবং ইঞ্জিন ২-এর ফুয়েল কাটঅফ সুইচ ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফ’-এর পজ়িশনে সরে যায় এবং দুটি ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যায়।
এনহ্যান্সড এয়ারবর্ন ফ্লাইট রেকর্ডার অর্থাৎ ব্ল্যাক বক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে,সময় অল্প হলেও ফের পাইলটরা জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সুইচগুলিকে CUT OFF থেকে RUN-এ ফিরিয়ে আনেন। ফুয়েল সরবরাহ শুরু হতেই ইঞ্জিন ১ চালু হলেও তা স্থিতিশীল হয়নি। আর ইঞ্জিন ২ও আর চালুই হয়নি। তবে,EAFR রেকর্ডিং কয়েক সেকেন্ড পরে বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই, একজন পাইলট এটিসি-কে MAYDAY সতর্কবার্তা পাঠান। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কল সাইন সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করলেও আর জবাব মেলেনি। তার পর ৬২৫ ফুট উচ্চতা থেকে প্রতি মিনিটে ৪৭৫ ফুট বেগে গোত্তা খেতে খেতে নীচে নামতে শুরু করে বিমানটি।
১) টেকঅফের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাঝ আকাশে বন্ধ হয়ে যায় ফ্লাইট এআই-১৭১-এর দু’টি ইঞ্জিনই।
২) তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ, মাটি থেকে ওড়ার এক সেকেন্ডের মধ্যে ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইঞ্জিন ১ এবং ইঞ্জিন ২-এর ফুয়েল কাটঅফ সুইচ ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফ’-এর পজ়িশনে সরে যায়।
৩) ককপিট অডিয়োতে শোনা গিয়েছে, এক পাইলট অন্যজনকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি জ্বালানি বন্ধ করে দিলেন কেন?’ দ্বিতীয় পাইলট জবাবে বলেন, ‘আমি জ্বালানি বন্ধ করিনি।’
৪) জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হতেই কাজ করা থামিয়ে দেয় ইঞ্জিন ১ এবং ইঞ্জিন ২। দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে টেকঅফের সঙ্গে সঙ্গেই ফ্লাইট AI 171-এর রাম এয়ার টারবাইন (RAT) ছিল সক্রিয়। সমস্ত ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সক্রিয় হয় এটি।
৫) পাইলটদের প্রচেষ্টায় ইঞ্জিন ১ শেষ মুহূর্তে চালু হলেও স্থিতিশীল হয়নি। ইঞ্জিন ২ আর চালু করা যায়নি। ফলে গতি হারিয়ে ক্র্যাশ করে বিমানটি।
৬) ব্ল্যাকবক্স অনুযায়ী টেকঅফ থ্রাস্ট সক্রিয় ছিল, কিন্তু থ্রাস্ট লিভার নিস্ক্রিয় অবস্থায় ছিল—যা সংযোগ বিচ্ছিন্নতা বা যান্ত্রিক ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়।
৭) বিমানের জ্বালানি উপযুক্ত মানের ছিল। তাতে কোনও কারচুপি, ভেজাল মেশানোর প্রমাণ মেলেনি।
৮) টেকঅফের সময় ফ্ল্যাপ (৫°) ও ল্যান্ডিং গিয়ার (নিচে) স্বাভাবিক ছিল।
৯) ফ্লাইট AI 171-এর সঙ্গে কোনও পাখির ধাক্কা লাগেনি। এমনকী আবহাওয়াও অনুকূল ছিল। দৃশ্যমানতারও কোনও সমস্যা ছিল না।
১০) ফ্লাইটের উভয় পাইলট ক্যাপ্টেন সুমিত সাবারওয়াল এবং ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দর একদম সুস্থ ছিলেন। দু’জনেই যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন।
১১) বিমান দুর্ঘটনার পিছনে নাশকতার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
১২) জ্বালানি সুইচ ত্রুটি সম্পর্কে FAA-এর দেওয়া নির্দেশিকা মানেনি এয়ার ইন্ডিয়া।
১৩) বিমানটি মোট ৩২ সেকেন্ড আকাশে ছিল এবং রানওয়ে থেকে ০.৯ নটিক্যাল মাইল দূরে ডাক্তারি পড়ুয়াদের হস্টেলের উপর ভেঙে পড়ে।
উল্লেখ্য, ওই দিন ফ্লাইট AI 171-এর ককপিটে ছিলেন, ক্যাপ্টেন সুমিত সাবারওয়াল। ঠান্ডা মাথা, মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার জন্য বিশেষ সুনাম ছিল তাঁর। ঝুলিতে ছিল ৮ হাজার ২০০ ঘণ্টা উড়ানের অভিজ্ঞতা। বিমানের কো পাইলট ছিলেন ফার্স্ট অফিসার ক্লাইভ কুন্দর। তাঁর ঝুলিতেও ছিল ১ হাজার ১০০ ঘণ্টা বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা। আমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনার পরেই এই দু’জনের অভিজ্ঞতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলেছে। বিমানের দুই পাইলটের সম্মিলিত উড়ানের অভিজ্ঞতা ছিল প্রায় ১০ হাজার ঘণ্টার কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি।
প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর ফুয়েল সুইচ, এয়ার ইন্ডিয়া-এর FAA-এর দেওয়া নির্দেশিকা না মানা,পাইলটদের শেষ অডিয়ো, এরকম একাধিক বিষয় নিয়ে আরও বিস্তারিত তদন্ত করা হবে বলে সূত্রের খবর।
১২ জুনের ওই বিমান বিপর্যয়ের ঘটনায় ২৪২ জন বিমান যাত্রীদের মধ্যে থেকে বেঁচে ফিরেছেন মাত্র একজন। ফ্লাইট ১৭১-এর ১১এ নম্বর সিটের যাত্রী বিশ্বাসকুমার রমেশ। বাকি ২২৯ জন যাত্রী ও ১২ জন বিমানকর্মী-সহ আরও কমপক্ষে ৩০ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয় এই দুর্ঘটনায়।