Barun Biswas Death Anniversary : মনে পড়ে বরুণ বিশ্বাসকে? ১৩ বছর পার! প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে বদলা হয়েছে, বদলায়নি শাসক!
ডিজিটাল ডেস্ক, ৫ জুলাই : ১৩ বছর আগে, ২০১২ সালের ৫ই জুলাই, ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকারের শাসনকালে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বরুণ বিশ্বাসকে—এক অকৃতদার, সাহসী ও জনপ্রিয় বাংলা শিক্ষক, যিনি শিয়ালদহ মিত্র ইন্সটিটিউশনে পড়াতেন (Barun Biswas Death Anniversary)। গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তিনি এলাকায় বিশেষভাবে সম্মানিত ছিলেন। সুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা বরুণ প্রতিদিনই মোটরবাইকে করে গোবরডাঙ্গা স্টেশনে যেতেন। সেখান থেকে বাইকটি রেখে বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল ট্রেনে চেপে স্কুলে পৌঁছাতেন। দিনের শেষে তিনি আবার গোবরডাঙ্গা স্টেশনে নেমে নিজের বাইকে করে প্রায় আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরতেন—ঠিক যেন এক নিরলস যোদ্ধার মতো।
২০১২ সালের ৫ই জুলাই সন্ধ্যায়, বাড়ি ফেরার সময় গোবরডাঙ্গা স্টেশন চত্বরে মোটরবাইকে ওঠার মুহূর্তে লুকিয়ে থাকা আততায়ীরা কাছ থেকে গুলি চালায় বরুণ বিশ্বাসের ওপর। গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বরুণ, আর আততায়ীরা তাঁকে ঘিরে ধরে, যাতে কেউ তাঁর পাশে দাঁড়াতে না পারে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। বরুণ তখনও প্রাণে ছিলেন এবং তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন উপস্থিতদের। কিন্তু সেই সময় শুরু হয় দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক—রেল পুলিশ না কি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে চলে অমূলক তর্ক। এই সময়ক্ষেপণের মধ্যেই বরুণের রক্ত ক্ষরণ বেড়েই চলে, যা শেষমেশ প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। সবশেষে, প্রায় মৃত অবস্থাতেই তাঁকে হাবড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বরুণ বিশ্বাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড রাজ্যজুড়ে ক্ষোভ ও বেদনার সঞ্চার করে। শুধুমাত্র স্থানীয় নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সরব হন। প্রত্যেকে এক সুরে দাবি তোলে—“খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।” জনমতের সেই প্রবল চাপের মুখে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তদন্তভার সিআইডির হাতে তুলে দেন। সরকারিভাবে আশ্বাস দেওয়া হয়—এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।
১৩টি বছর কেটে গেছে। তবুও শহীদ বরুণ বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যরা—বাবা জগদীশ বিশ্বাস, প্রয়াত মা গীতা বিশ্বাস, বড়দি প্রমিলা রায় বিশ্বাস, বড় দাদা অসিত কুমার বিশ্বাস, মেজদা এবং ছোট বোন—এখনও ন্যায়ের আশায় বুক বেঁধে প্রতিবাদী জনতার সঙ্গে পথে নামেন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে ‘আক্রান্ত আমরা’ মঞ্চ সহ রাজ্যের বহু সাধারণ মানুষ, যাঁরা বরুণের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চান। জগদীশ বিশ্বাস, যিনি আজ বিচার চেয়ে রাষ্ট্রপতি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সহ একাধিক কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু ন্যায় আজও অধরা। এর মধ্যেই, মা গীতা বিশ্বাস ছেলের জন্য অশ্রুজলে বিবর্ণ হয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। আর বৃদ্ধ পিতা জগদীশ বিশ্বাস অনেক যন্ত্রণা, হতাশা ও অপূর্ণ আশা নিয়ে আজ জীবনের শেষ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছেন—নির্বাক চোখে আকাশের দিকে চেয়ে তিনি যেন পুত্রের ন্যায়ের প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন।
শহীদ বরুণ বিশ্বাসের বড়দি ও ‘আক্রান্ত আমরা’ মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রমিলা রায় বিশ্বাসকে এবার এক নতুন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। শাসকদলের এক স্থানীয় নেতা, বিধায়ক এবং এক সময় জেলবন্দি থাকা এক মন্ত্রী (বর্তমানে জামিনে মুক্ত) তাঁর বিরুদ্ধে বিধাননগর আদালতে পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলা শুধু আইনি লড়াই নয়—প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর দমন করার একটি স্পষ্ট প্রয়াস বলেই অনেকের মত। ফলত, নিয়মিতভাবে আইনজীবীর সঙ্গে আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছেন প্রমিলা, যেখানে সঙ্গে চলছে অর্থনৈতিক চাপ, মানসিক যন্ত্রণা ও একপ্রকার সামাজিক হেনস্থা। তবু থেমে যাননি প্রমিলা—এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি এখনও মাথা উঁচু করেই পথ চলছেন, বরুণ বিশ্বাসের মতাদর্শ ও লড়াইয়ের উত্তরাধিকার বহন করে।
১৩ বছর পেরিয়েও বরুণ বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের মূল মামলায় বনগাঁ আদালতে নিয়মমাফিক শুনানি না হওয়ায় এবং প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে সন্দেহ দানা বাঁধায়, শহীদের পরিবার অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁরা দ্রুতবিচারের দাবি জানিয়ে মামলা করেছেন, কারণ দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচার ব্যবস্থার জটিলতায় যেন প্রকৃত তথ্যের অপমৃত্যুই ঘটছে বারবার।
১৩ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরেও শহীদ বরুণ বিশ্বাস হত্যার বিচারের অভাবে ক্ষুব্ধ ‘আক্রান্ত আমরা’ মঞ্চের মতে, মুখ্যমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে বিচার না চান, তবে তা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাঁদের অভিযোগ—বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, যিনি একইসাথে পুলিশ দফতরের দায়িত্বেও রয়েছেন, তিনি কার্যত গুন্ডা-নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকায় রয়েছেন, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখছে। ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও শাসকের রোষানলে প্রতিবাদীরা। ‘মা-মাটি-মানুষ’ সরকারের গত ১৪ বছরের শাসনকালে একের পর এক নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার নজির রয়ে গেছে—তপন দত্ত, পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড, শিলাদিত্য চৌধুরী, কামদুনি, ধূপগুড়ি, সুদীপ্ত গুপ্ত, মইদুল ইসলাম মিদ্দা, আনিস খান, আর.জি. কর হাসপাতালে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ড, তামান্না খাতুনের মৃত্যু (যার পেছনে শাসকদলের ছোঁড়া সকেট বোমার অভিযোগ), সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে সংঘটিত গণধর্ষণ এবং মনোজিৎ মিশ্রার গ্রেপ্তার-সহ অসংখ্য ঘটনা তারই নিদর্শন।