ডিজিটাল ডেস্ক, ১১ অগাস্ট : ‘ফ্যাসিস্ট’ ইউনুস সরকারকে হঠাতে এবার গণআন্দোলনের ডাক দিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে জনতার সামনে ২১ দফা দাবি তুলে ধরেছেন মুজিবকন্যা (Hasina Calles For Mass Protest)। তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে সরিয়ে ক্ষমতা দখলকারী ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে এবং দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রবিবার, আওয়ামী লিগের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডেল থেকে ২১ দফা দাবি পেশ করলেন মুজিবতনয়া শেখ হাসিনা। এসব দাবির মূল লক্ষ্য—বাংলাদেশে একটি সুস্থ ও কার্যকর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা।
তাঁর প্রস্তাবিত ২১ দফার মধ্যে রয়েছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা, এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহ্যবাহী কিন্তু অবহেলিত ও ধ্বংসপ্রায় স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ ও পুনঃসংস্কার।
এই দাবিগুলোর ভিত্তিতে শেখ হাসিনা ‘ফ্যাসিস্ট’ বলে আখ্যায়িত ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সোনার বাংলায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী শাসকদের সরাতে আরেকবার ‘মুক্তিযুদ্ধ’-এর মতো জনজাগরণ প্রয়োজন।
আর কয়েক মাসের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সেই লক্ষ্যে এখন থেকেই কার্যত নির্বাচনী ময়দানে নেমে পড়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই গত দু’মাসে দু’বার রাজ্যে সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি—একবার আলিপুরদুয়ারে, অন্যবার দুর্গাপুরে। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ, দুই প্রান্ত থেকেই তিনি তৃণমূল সরকারকে উৎখাতের ডাক দিয়েছেন ২০২৬-এর ভোটকে সামনে রেখে। এছাড়াও, রাজ্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক সেরে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তারপরে মাস ঘোরার আগেই আবারও রাজ্যে আসছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। যদিও তাঁর সফরের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে বিজেপির অন্দরে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে আমরণ লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা—“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—বাংলাদেশের ইতিহাসে গেঁথে আছে গর্বের প্রতীক হিসেবে।
সেই দিনগুলো পেরিয়ে গেছে প্রায় ৪৫ বছর। পদ্মা, মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্রের জলে অনেক পরিবর্তন বয়ে গিয়েছে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়, যার ফলস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন তিনি। ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক মুজিব বাসভবনে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের স্মৃতি আজও বেদনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এই শূন্যতার মাঝেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের বিরুদ্ধে একাধিকবার আওয়ামি লিগের কর্মী-সমর্থকদের উপর দমনপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, বিভিন্ন মন্দিরে ভাঙচুর এবং ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোও একেবারে ভেঙে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকতে নারাজ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। রোববার আওয়ামী লিগের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে এক দীর্ঘ চিঠি প্রকাশ করে বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি পেশ করেন ২১ দফা দাবি। সেই চিঠিতে তিনি তুলে ধরেছেন দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি, খর্ব হওয়া নাগরিক অধিকার, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের মতো একের পর এক সংকটের চিত্র। নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি লেখেন, “এ যেন একাত্তরের খান সেনাদের প্রত্যাবর্তন।” শেখ হাসিনার সরাসরি আহ্বান—দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ যেন আবার রুখে দাঁড়ায়। যেন আবার শুরু হয় এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ—এইবার ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসনের বিরুদ্ধে।
এক্স হ্যান্ডেলে বাংলাদেশের জনতার উদ্দেশ্যে ২১ দফা দাবি পেশ করে অন্তর্বর্তী ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে সরব হলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দাবি—বাংলাদেশকে ফের গণতন্ত্রের পথে ফেরাতে এই সরকারকে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। ‘সোনার বাংলা’ গড়ার ডাক দিয়ে মুজিবকন্যা তুলে ধরেছেন যে ২১টি দাবি, তা নিম্নরূপ—
১. জনগণের ভোটে নির্বাচিত শেখ হাসিনার সরকারকে অসাংবিধানিকভাবে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকারকে অবিলম্বে সরিয়ে ফের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২. ইউনুস সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় উপেক্ষা করে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা কায়েম রেখে যেসব ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছে, তার নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। একইসঙ্গে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও এনায়েতুর রহিমের বাড়িতে হামলারও বিচার চাই।
৩. প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে ভুয়ো মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. শেখ হাসিনার ছেলে ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও যে মিথ্যা মামলা রুজু হয়েছে, সেগুলিও প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
৫. ইউনুস সরকারের আমলে আওয়ামি লিগের বহু নেতা, কর্মী ও সমর্থককে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।
৬. ভিন্নমত দমন করতে গঠিত অবৈধ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করতে হবে এবং সেসব মামলাও প্রত্যাহার করতে হবে।
৭. রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে দেশের স্বাধীনচেতা মানুষকে। নিষিদ্ধ আওয়ামি লিগ কর্মীদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তাঁদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর ফেরত দিতে হবে।
৮. সেন্ট মার্টিন্স আইল্যান্ড, চট্টগ্রাম পোর্ট এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বিদেশি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে।
৯. বেআইনিভাবে বরখাস্ত করা সরকারি কর্মীদের পুনর্বহাল করতে হবে এবং বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় সবধরনের অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
১০. ১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে সংখ্যালঘু ও আওয়ামি লিগ সমর্থকদের উপর সংঘটিত হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হিংসার ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
১১. জাতীয় প্রতীক—বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এবং শহীদ মিনার রক্ষা করতে হবে; যারা এসব ধ্বংস করেছে, তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
১২. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, আটক সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে এবং তাঁদের সংস্থার মালিকানা ফেরত দিতে হবে।
১৩. জাতির জনক মুজিবুর রহমানের প্রতি অবমাননা বন্ধ করতে হবে এবং তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর পুনঃনির্মাণ করতে হবে।
১৪. উগ্রপন্থীদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৫. শিক্ষাঙ্গনে হিংসা বন্ধ করে অবিলম্বে বহিষ্কৃত ছাত্র ও শিক্ষকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরাতে হবে।
১৬. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মৌলবাদী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে এবং তাঁদের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৭. নারী নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করে তাঁদের অধিকার ও সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে।
১৮. ইউনুস সরকারের আমলে বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বন্ধ করে দরিদ্রদের রক্ষা করতে হবে।
১৯. ধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে, বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্পগুলিকে পুনরায় চালু করতে হবে এবং বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
২০. আওয়ামি লিগের সব কারাবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। পুলিশ হেফাজতে ও কারাগারে মৃত্যুর ঘটনাগুলির যথাযথ তদন্ত করতে হবে।
২১. দেশের সর্বত্র শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। হিংসা ও মধ্যযুগীয় কায়দায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এই ২১ দফাকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা দেশের জনগণকে নতুন আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন—গণতন্ত্র, ন্যায় ও মানবাধিকারের সুরক্ষায়।