বাজেনি অ্যালার্ম! অকেজো আগুন নেভানোর যন্ত্রও! এ ভাবেই চলছিল বড়বাজারের হোটেল?

10

কলকাতা, ৩০ এপ্রিল: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বড়বাজারের মেছুয়াবাজারে একটি হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকা। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ওই ঘটনায় শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪। ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ হোটেলের মালিক, যাঁর ভূমিকা নিয়েই শুরু থেকে উঠছে প্রশ্ন।

প্রাথমিকভাবে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব এবং মালিকপক্ষের গাফিলতি নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর দমকলের আধিকারিক রনবীর কুমার জানান, “আগুন লাগে একতলা থেকে। হোটেলে প্রচুর দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল, যার জেরে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গোটা এলাকা। ফায়ার অ্যালার্ম কাজ করেনি, এবং ২০২২ সালের পর থেকে ফায়ার লাইসেন্স নবীকরণ হয়নি।” তিনি আরও জানান, দমকল বিভাগের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

মেছুয়াবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘিরে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই হোটেলে বেআইনিভাবে পরিচালিত হচ্ছিল একটি পানশালা। এছাড়াও, গত কয়েক মাসে হোটেলের ছয়তলা বাদে বাকি প্রায় সব উন্মুক্ত জায়গা ইট ও সিমেন্ট দিয়ে আটকানো হয়েছিল, যার ফলে পুরো হোটেল কার্যত বদ্ধ কাঠামোয় পরিণত হয়। জানা যাচ্ছে, এই কারণেই আগুন লাগার পর ঘন ধোঁয়া বাইরে বেরোতে পারেনি, এবং ভিতরে আটকে পড়া মানুষরা দমবন্ধ হয়ে প্রাণ হারান। আরও একটি গুরুতর অভিযোগ, ১৯৯৩ সালে নির্মিত এই হোটেলের ছাদে সম্প্রতি বেআইনিভাবে আটটি ঘর তৈরি করা হয়েছিল।

প্রাথমিক তদন্তে দমকল বিভাগের ধারণা, মেছুয়াবাজারের ওই হোটেলে আগুনে নয়, ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়েই মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। জানা যাচ্ছে, হোটেলের দোতলায় প্লাইউডের কাজ চলছিল, সেখান থেকেই আগুন ও ঘন ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভবনে। ধোঁয়া ক্রমে উপরের তলাগুলিতে উঠতে থাকায় তিনতলা ও চারতলায় থাকা আবাসিকেরা নীচে নামতে পারেননি, ফলে তাঁরা আটকে পড়েন। এই প্রসঙ্গে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে—উপরের তলাগুলিতে থাকা জানলাগুলি দিয়ে ধোঁয়া বের হতে পারল না কেন? বিশেষত, হোটেলে কেন্দ্রীয় শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (সেন্ট্রাল এসি) না থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ জানলা কেন বন্ধ ছিল, তা নিয়ে উঠছে বড়সড় প্রশ্ন।

হোটেলের বাইরে থেকে দেখা গিয়েছে, বেশ কয়েকটি জানলা ইট-সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই কাজের নেপথ্যে কোন কারণ ছিল, প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে এই কাজ করা হয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, হোটেলের অন্য একটি অংশে আরও একটি সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের সময় শাটার দিয়ে ওই সিঁড়়ির প্রবেশপথ বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে যদিও শাটার খুলে দেওয়া হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় ওই হোটেল বিয়েবাড়ি হিসেবে ভাড়া দেওয়া হত এবং তখন দুটি সিঁড়িই ব্যবহারযোগ্য ছিল। পরে একটি সিঁড়ির পথ শাটার দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, এবং সেখানেই প্লাইউড রাখা ছিল ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল বলে খবর। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—এত সংখ্যক অনিয়ম চলতে থাকলেও কেন স্থানীয় পুর প্রশাসনের নজরে আসেনি বিষয়টি? ইতিমধ্যেই দমকল বিভাগ থানায় হোটেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। হোটেলের দুই মালিক পলাতক, এবং এখনও তাঁদের খোঁজ মেলেনি।

প্রসঙ্গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ মধ্য কলকাতার মেছুয়ার ফলপট্টির একটি হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, মৃতদের মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে দমবন্ধ হয়ে, আর একজনের মৃত্যু হয়েছে আতঙ্কে কার্নিস থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ফলে। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশ একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT) গঠন করেছে, যারা এই অগ্নিকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ তদন্তে নেমেছে।

Comments are closed.