ডিজিটাল ডেস্ক, ২০ মে : গত চার বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনা এবং ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনও আর্থিক অনুদান পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে, রাজ্যের কোষাগারের অর্থ দিয়েই এই তিন প্রকল্পের ‘বঙ্গীয় সংস্করণ’ চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আবারও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বকেয়া অর্থের দাবিতে সরব হয়েছেন (Mamata Banerjee On Central Due)। সেই সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি কোনও জাদুকর নন, যে ইচ্ছে করলেই আকাশ থেকে টাকা এনে প্রকল্প চালিয়ে যেতে পারবেন।
সোমবার উত্তরবঙ্গ সফরে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার জলপাইগুড়িতে তিনি সরকারি পরিষেবা প্রদানসহ একাধিক প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করেন। সেই মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্রের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। চার বছর ধরে আবাস, সড়ক এবং ১০০ দিনের কাজের জন্য কোনও অর্থ দেওয়া হয়নি, তবুও আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমি ম্যাজিশিয়ান নই যে, আকাশ থেকে টাকা পড়বে। এটি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার মতো নয়—টাকা আসতে হয়, কেন্দ্র থেকে রাজ্যে!’’
বার্তা দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দাঁত থাকতে আমরা অনেকে দাঁতের মর্ম বুঝি না। দাঁতের মর্ম বোঝার চেষ্টা করুন। মমতা ব্যানার্জিকে গালাগাল দিতে গিয়ে সরকারকে অপমান, বাংলাকে অসম্মান করবেন না।’’
গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে যে জুন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকারকে সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ২৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে। একবারে এই অর্থ পরিশোধ করতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। এই পরিস্থিতির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আমি ম্যাজিশিয়ান নই যে, উপর থেকে টাকা পড়বে’ মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে তিনি সরাসরি ডিএ প্রসঙ্গ তোলেননি। যদিও সোমবার ডিএ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘‘কোর্টের কেসের ব্যাপারে আমি কিছু বলি না।’’
ডিএ মামলার শুনানিতে রাজ্যের পক্ষ থেকে আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি সরকারের আর্থিক অবস্থার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। আদালত প্রথমে বকেয়া ডিএ-র ৫০ শতাংশ পরিশোধের প্রস্তাব দেয়। তবে সিঙ্ঘভি জানান, এই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করলে রাজ্য বড় আর্থিক সংকটে পড়বে। শেষ পর্যন্ত, শীর্ষ আদালত বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ পরিশোধের নির্দেশ দেয় এবং রায়ে বলা হয়, ছ’সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের এই অর্থ দিতে হবে।
মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গের কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের বকেয়া অর্থ এবং রাজ্যের ব্যয়ের তুলনামূলক পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। সেই মঞ্চ থেকেই তিনি ঘোষণা করেন, ‘‘আজ থেকেই বাংলার বাড়ি প্রকল্পের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ১২ লক্ষ উপভোক্তাকে প্রদান শুরু হবে।’’ গত ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের প্রথম কিস্তির অর্থ দেওয়া হয়েছিল, এবং তখনই জানানো হয়েছিল যে মে মাসে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পৌঁছাবে। ১২ লক্ষ মানুষকে বাড়ি নির্মাণে সহায়তা দিতে রাজ্যের ব্যয় হচ্ছে ১৪,৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া, চলতি বছরের ডিসেম্বরে আরও ১৬ লক্ষ উপভোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বাংলার বাড়ি প্রকল্পের প্রথম কিস্তির অর্থ প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পরবর্তী বছরের মে মাসে পৌঁছাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু চললে, তখন বিধানসভা নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে।
সোমবার শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গের বণিক মহলকে নিয়ে বাণিজ্য সম্মেলন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপরই বিজেপি, সিপিএম-সহ বিরোধীরা প্রশ্ন তোলেন—সম্মেলন তো হল, কিন্তু বিনিয়োগের পরিমাণ কত? মঙ্গলবার, তাদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টা জবাব দেন, ‘‘কেউ কেউ বলছেন, কত বিনিয়োগ হয়েছে, তা বলা হয়নি! কেন বলব? আপনাকে বলতে হবে কেন? শুধু ডেউচা পাঁচামিতে যে বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটাই কি জানা আছে?’’
করব্যবস্থা নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘জিএসটি চালু হলেও রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ দেওয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি, একদিকে সড়কে কর নেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের উপর অতিরিক্ত করের চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এ ধরনের দ্বৈত করব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে—একটির নির্বাচন করুন।’’ তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার প্রসঙ্গ টেনে, নাম না-করে বিজেপিকে কটাক্ষ করেন। মমতার বক্তব্য, ‘‘আমরা যে কথা দিই, তা রক্ষা করি। সারা বিশ্বে প্রথম আমরাই লক্ষ্মীর ভান্ডার চালু করেছি। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশও ঘোষণা করেছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন করেনি। ওরা প্রতিশ্রুতি রাখে না, আমরা রাখি।’’
মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন যে মঙ্গলবারের কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা মোট দু’লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, তিনি একাধিক রাস্তার নতুন নির্মাণ ও সংস্কার করেছেন, এবং হাসপাতাল, স্কুল ও কলেজের উদ্বোধন ও শিলান্যাস করেছেন। গত সপ্তাহে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও আলিপুরদুয়ারের প্রাক্তন সাংসদ জন বার্লা আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। মঙ্গলবার তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি কর্মসূচির মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। বুধবার উত্তরকন্যায় উত্তরবঙ্গের ৮টি জেলার প্রশাসনিক বৈঠক করবেন মুখ্যমন্ত্রী, এবং বৃহস্পতিবার তাঁর কলকাতায় ফেরার কথা রয়েছে।
Comments are closed.