Narendra Modi On Bengali Sentiment : জয় শ্রীরাম নয়, ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’ বলে ভাষণ শুরু মোদীর! বাঙালী অস্মিতায় শান?
ডিজিটাল ডেস্ক, ১৮ জুলাই : শমীক ভট্টাচার্য রাজ্য বিজেপির সভাপতি হওয়ার পর থেকেই পরিবর্তনের আভাস মিলেছিল। এবার দুর্গাপুরের সভা থেকে সেই পরিবর্তনের উপর কার্যত সিলমোহর দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi On Bengali Sentiment)। বঙ্গ বিজেপির ‘বঙ্গীয়করণ’-এর রূপরেখা এবার আরও স্পষ্ট। সভার শুরুতেই দেখা গেল নতুন এক মোদিকে—রামনামের বদলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ শুরু করেন খাঁটি বাংলায়, মা দুর্গা ও মা কালীর নাম উচ্চারণ করে। একেবারে এক বাঙালির মতো ভাষণ শুরু করে মোদি জানিয়ে দিলেন, বাংলার মাটিতে বিজেপির কণ্ঠস্বর এবার অনেক বেশি ঘরোয়া, অনেক বেশি বাঙালিয়ানায় মোড়া।
শুক্রবার দুর্গাপুরের সভায় ভাষণের শুরুতেই এক ভিন্ন মেজাজে ধরা দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভাঙা ভাঙা বাংলায় শুরু করেই বললেন, “বড়রা আমার প্রণাম নেবেন, ছোটরা ভালোবাসা। জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা।” সাধারণত বাংলায় এলে মোদি ভাষণের সূচনায় বাংলায় কিছু কথা বলেন। তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি যেভাবে বাংলার আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা মা কালী ও মা দুর্গার নাম উচ্চারণ করলেন, তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। ভাষণের বিভিন্ন অংশেও প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল বাংলা শব্দবন্ধ। কখনও বললেন, “বিকশিত বাংলা, মোদির গ্যারান্টি।” কখনও বললেন, “টিমসি যাবে, তবেই আসল পরিবর্তন আসবে।” আবার একাধিকবার “টিএমসিকে হঠাও, বাংলা বাঁচাও” স্লোগান তুললেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, তাঁর সরকারের আমলেই বাংলা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। মোদির কথায়, “বিজেপির কাছে বাংলার অস্মিতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। আমরা বাংলাকে প্রেরণার উৎস হিসেবে দেখি।” এদিনের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন বাংলার গর্ব – কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও বিধানচন্দ্র রায়ের মতো কিংবদন্তিদের নাম, যার মাধ্যমে একদিকে ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যদিকে ভোটের আগে বাঙালি আবেগে যুক্ত হওয়ার বার্তা স্পষ্ট করে দেন তিনি।
আসলে এই মুহূর্তে বঙ্গ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে ‘বাঙালি অস্মিতা’। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য দেশের নানা প্রান্তে বাঙালিভাষীদের হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। কোথাও নির্বিচারে ধরপাকড়, কোথাও বাংলাদেশি তকমা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া, কোথাও বা কর্মক্ষেত্রে নিগ্রহ – প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূলের অভিযোগের নিশানায় রয়েছে বিজেপি। ফলে রাজনীতির ময়দানে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘বাঙালি-বিরোধী’ এবং ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদী’ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে শাসক শিবির। দিলীপ ঘোষ বা শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতাদের আগ্রাসী ও বিতর্কিত মন্তব্য সেই ধারণাকে আরও জোরদার করেছে। বিজেপি যতই রামনবমীর মতো ধর্মীয় উৎসব ঘিরে রাম নামের জয়ধ্বনি তুলে জনসমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা করুক, একাংশ বাঙালি সেই স্লোগানের সঙ্গে আবেগগতভাবে নিজেদের মেলাতে পারেননি—এমনটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একাধিক নির্বাচনের ফলাফলে। রামনাম যতই তোলপাড় করুক রাজনীতির মঞ্চে, ভোটের বাক্সে তার প্রভাব যে সীমিত, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে বিজেপির কাছে। সম্ভবত সে কারণেই এখন তারা নতুনভাবে বঙ্গীয় আবেগ ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে চাইছে—যার প্রতিফলন দেখা গেল দুর্গাপুরের সভায় প্রধানমন্ত্রী মোদির ‘জয় মা কালী, জয় মা দুর্গা’ উচ্চারণে।
সম্ভবত সেই কারণেই দুর্গাপুরের সভায় বাংলার আপন দেবী মা কালী ও মা দুর্গার আশ্রয় নিয়ে দলের ভাবমূর্তি ঘষেমেজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর বক্তব্যে বাঙালি সংস্কৃতি, আবেগ ও ধর্মাচরণের সঙ্গে দলকে আরও বেশি সংযুক্ত করার প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
তবে এসব কৌশলের পরও বেশ কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সভায় প্রধানমন্ত্রী একবারও উচ্চারণ করেননি ভিনরাজ্যে বাঙালিদের উপর হওয়া হেনস্তার ঘটনা নিয়ে। বাংলা ভাষা বলার ‘অপরাধে’ বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালিদের আটক, নিগ্রহ বা বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করার অভিযোগগুলির কোনও উত্তর বা খণ্ডনও দেননি তিনি। ফলে বিরোধীরা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলছে—ভিনরাজ্যে বাঙালিদের ‘ঠেঙিয়ে’ বাংলায় এসে কালীর নাম উচ্চারণ করলেই কি সব মাফ হয়ে যাবে? শুধু আবেগে ভর করে কি বদলানো যাবে বিজেপির ইতিবাচক ভাবমূর্তি? তৃণমূল ইতিমধ্যেই তীব্র কটাক্ষ করেছে। দলের তরফে বলা হয়েছে, “আপনি তো বাংলায় ভাষণ শুরু করলেন, সেটা খুবই ভালো। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—আপনাকেও কি ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে না তো?” এই ব্যঙ্গের মাধ্যমে স্পষ্ট, তৃণমূল বিজেপির ‘বঙ্গীয়করণ’ কৌশলকে সহজে ছাড় দিতে রাজি নয়। বরং তারা মনে করছে, যাঁরা বাইরে বাংলাকে অসম্মান করেন, তাঁদের মুখে বাংলার দেবীকে ডাকলে সেটা রাজনৈতিক ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।