পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি? ইতিহাসে ব্রাত্য দক্ষিণের ঐতিহ্য? সরব অভিনেতা আর মাধবন

11

ডিজিটাল ডেস্ক, ৩ মে: পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ঘিরে এবার মুখ খুললেন অভিনেতা আর মাধবন। বর্তমানে স্কুলে যে ধরনের ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। মাধবনের অভিযোগ, দেশের ইতিহাসের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের গৌরবময় অতীত, পাঠ্যক্রমে উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।

ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে পাঠ্যক্রম নিয়ে কড়া প্রশ্ন তুলেছেন অভিনেতা আর মাধবন। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “হয়তো এর ফলে আমাকে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। কিন্তু এই কথা বলতেই হবে।” নিজের স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মাধবন বলেন, “আমরা যখন স্কুলে ইতিহাস পড়েছি, তখন মুঘলদের নিয়ে ছিল আটটি অধ্যায়, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো নিয়ে দুটি, ইংরেজ শাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে চারটি অধ্যায়। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের চোল, পাণ্ড্য, পল্লব ও চেরা সাম্রাজ্যের ইতিহাস ছিল মাত্র একটি অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ।”

মাধবনের মতে, এই বিভাজন ইতিহাসের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করে। তিনি বলেন, “চোল সাম্রাজ্যের ইতিহাস প্রায় ২৪০০ বছরের, যেখানে মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনের যৌথ ইতিহাস মাত্র ৮০০ বছর। চোলদের হাত ধরেই ভারতে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী নৌবাহিনী। তারা সমুদ্রপথে রপ্তানি করত মশলা, যা পৌঁছে যেত রোম পর্যন্ত। আঙ্কর বাট মন্দিরের (কম্বোডিয়া) নির্মাণেও তাদের ভূমিকা ছিল। চিনে বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু ধর্মের প্রসারে তাদের অবদান রয়েছে। এমনকি কোরিয়ার বহু মানুষ আজও অর্ধেক তামিল ভাষায় কথা বলেন—আমাদের ভাষা সেখানেও পৌঁছে গিয়েছিল।”

তামিল ভাষার প্রতি দীর্ঘদিনের উপেক্ষা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনেতা আর মাধবন। তাঁর সোজাসাপ্টা প্রশ্ন, “তামিল পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। অথচ এই ভাষাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, তার উদযাপনও হয় না। কেন? এটা কার লেখা ইতিহাস? কে ঠিক করে পাঠ্যসূচি?”
মাধবনের মতে, শুধুমাত্র ভাষাই নয়, ভারতের প্রাচীন বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার ধারাকেও আজকের পাঠ্যক্রমে অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের যে বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে, তাকে এখন উপহাস করা হচ্ছে, তুচ্ছ করে দেখা হচ্ছে।”

‘Kesari Chapter 2’ ছবির প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহৃত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরেও পাঠ্যবইয়ের উপস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিনেতা আর মাধবন। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট অসন্তোষ ধরা পড়েছে। মাধবন বলেন, “পাঠ্যবইয়ে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের যে বর্ণনা রয়েছে, তাতে ইংরেজদের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে—যেন মনে করানো হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমাদেরই কোথাও কোনও ভুল ছিল।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “একটি গণহত্যার ঘটনাকেও যদি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে সেখানে শোষকদের দৃষ্টিকোণই গুরুত্ব পায়, তাহলে ইতিহাস কীভাবে নিরপেক্ষ ও শিক্ষা দিতে সক্ষম হবে?”

মাধবনের মন্তব্য ঠিক এমন এক সময়ে এসেছে, যখন পাঠ্যবই থেকে দিল্লির সুলতান ও মুঘল শাসকদের অধ্যায় বাদ দেওয়াকে কেন্দ্র করে জাতীয় স্তরে তীব্র বিতর্ক চলছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কাউন্সিল (NCERT) এই সিদ্ধান্তের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। বদলে ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে জায়গা পেয়েছে কুম্ভমেলা, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং ‘চারধাম যাত্রা’র মতো বিষয়।

এই বিতর্কের মধ্যেই ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে সরব হলেন অভিনেতা আর মাধবন। পাঠ্যবইয়ে দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস, তামিল ভাষা ও প্রাচীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার উপেক্ষার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে মুখ খুললেন। ফলে তাঁর মন্তব্য শুধু একটি মতামত নয়, বরং চলমান জাতীয় বিতর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপ হিসেবেই ধরা হচ্ছে।

Comments are closed.