ডিজিটাল ডেস্ক, ৩ জুলাই : বুধবার দুপুরেই নিশ্চিত হয়ে যায়, বঙ্গ বিজেপির রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব নিতে চলেছেন শমীক ভট্টাচার্য। বৃহস্পতিবার কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দায়িত্বে অভিষিক্ত করা হয়। নবনিযুক্ত সভাপতিকে স্বাগত জানান সদ্য প্রাক্তন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা—সুনীল বনশল, রবিশঙ্কর, মঙ্গল পাণ্ডে, অমিত মালব্য প্রমুখ। তবে নজর কাড়ে প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের অনুপস্থিতি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বার্তাতেই কড়া সুরে মুখ খুললেন শমীক (Shamik On Secularism)। তিনি বলেন, “এক সময় বাংলায় বিজেপিকে কেউ পাত্তাই দিত না, আমাদের ভোটের হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলেছে—বাংলার মানুষ তৃণমূলকে সরিয়ে বিজেপির সরকার আনার জন্য প্রস্তুত। এবার আর ২০০ পেরোনো নয়, তৃণমূলের বিদায় সুনিশ্চিত।” তিনি আরও দাবি করেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও বিকল্প মুখ নেই, এমন যুক্তি আর মানুষ মানছেন না। বাংলা স্থির করেছে—২০২৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূলকে বিদায় জানাবে। কারণ, মমতার ‘সততার’ ভাবমূর্তি আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে এবার রায় দেবে জনতা।”
বিজেপির বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু বিরোধী’ তকমা খারিজ করতে উদ্যোগী হয়েছেন শমীক। বাংলার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বার্তাতেই তিনি বলেন, “আমরা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নই, বরং বাংলায় সংখ্যালঘুরাও বারবার আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা চাই, উল্টোরথ ও মহরম—দুই উৎসবই যেন সৌহার্দ্যের আবহে একসঙ্গে উদ্যাপিত হয়।” সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে তাঁর আরও বক্তব্য, “মুসলমান মানেই সমাজবিরোধী—এই ছকবাঁধা ভাবনা পাল্টাতে হবে। যারা আমাদের অচ্ছুত মনে করেন, তাদের বলি—ভোট না দিলে ক্ষতি নেই, তবে একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখুন। বাংলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন মুসলমানরাই। কারা দায়ী এসবের জন্য? তাঁদেরই বিদায় জানানোর সময় এসে গেছে।”
পাশাপাশি তাঁর কথায়, “বিজেপির লড়াই কখনই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নয়—আমরা লড়ছি তাদের ভালোর জন্যই। আমরা চাই, ঘরের ছেলেরা পাথর নয়, বই হাতে নিক। যারা হাতে তুলেছে তলোয়ার, তাদের হাতে তুলে দিতে চাই কলম। এটাই আমাদের লক্ষ্য—আর আমরা সেটা করে দেখাব।”
নতুন রাজ্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রাজ্যের সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশে বার্তা দিলেন শমীক। তাঁর বক্তব্য, “নো ভোট টু বিজেপি স্লোগানের আড়ালে যেন কেউ ভোট কাটার খেলায় নামবেন না এবং সেই সুযোগে তৃণমূলকে পিছনের দরজা দিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরানোর চেষ্টা না করেন। অনুরোধ করব—নিজ নিজ দলের পতাকা কিছুদিনের জন্য সরিয়ে রেখে রাস্তায় নামুন, ২০২৬-এ তৃণমূলকে বিদায় দিন।”
দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ মেটানোর বার্তাও দেন শমীক। বলেন, “সবাইকে একসঙ্গে, ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে, কারণ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য বাংলাকে রক্ষা করা।” কর্মীদের মনোবল জোগাতে তিনি বলেন, “২০১১ সালে সিপিএমের বিশাল ব্রিগেড দেখে কেউ বুঝতে পারেননি তারা হারছে! তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিন, ২০২৬-এ তৃণমূলকে বিদায় জানাতে হবে।” তাঁর মন্তব্য, “তৃণমূলের একতরফা দাপট আর চলবে না। প্রয়োজনে কঠিন লড়াই হবে—তাদের বিদায় জানানোর লড়াই।”
২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের আহ্বান জানালেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর বার্তা, “ভাগ্যের উপর নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারের উপর নয়—নিজেদের কর্ম ও সাংগঠনিক শক্তির উপর জোর দিতে হবে। প্রতি বুথে ৩০ জন করে যোদ্ধা গড়ে তুলে তৃণমূলকে পরাজিত করতে হবে। এটাই হবে শমীক ভট্টাচার্যকে আমাদের তরফে প্রকৃত সংবর্ধনা।” সুকান্ত মজুমদার ২০২১ সালে দলের রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ছয় বছর এই পদে থাকতে পারেন। তাছাড়া বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী সভাপতির দায়িত্বে থাকা আর সম্ভব নয়। তাই নেতৃত্বে পরিবর্তন একপ্রকার নিয়মসিদ্ধ ছিল।
শমীক ভট্টাচার্যকে রাজ্য বিজেপির সভাপতি হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে একাধিক কারণ দেখছেন রাজনৈতিক মহল। তাঁদের ব্যাখ্যা—দলের ‘পুরনো’ এবং ‘নব্য’ দুই ধারার নেতাদের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে। অভিজ্ঞ, বাগ্মী এবং দীর্ঘদিন ধরে দলের এক গুরুত্বপূর্ণ মুখ হওয়ায় তিনিই এগিয়ে গেছেন। একসময় রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, বর্তমানে রাজ্যসভায় দলের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ১৯৭৪ সালে হাওড়ার মন্দিরতলায় আরএসএস শাখায় যাতায়াতের মাধ্যমে সঙ্ঘ-পরিবারের সঙ্গে তাঁর রাজনীতির শুরু। ২০০৬ সালে শ্যামপুকুর বিধানসভা আসন থেকে বিজেপির টিকিটে লড়লেও সাফল্য আসেনি। তথাগত রায়ের সভাপতিত্বকালে তিনি রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরে দিলীপ ঘোষ সভাপতি হওয়ার সময় তিনি মুখপাত্র নিযুক্ত হন, যদিও তখনও দলের অন্দরে অভিযোগ ছিল যে—তাঁকে প্রকৃত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
অবশেষে বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেন শমীক ভট্টাচার্য। এখন দেখার বিষয়—২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি দলকে কতটা সংগঠিত করতে পারেন, তা ঘিরেই রাজনৈতিক মহলের কৌতূহল ও প্রত্যাশা।