ডিজিটাল ডেস্ক, ১৫ জুলাই : আর মাত্র তিন ঘণ্টার অপেক্ষা! তারপরই ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে নামবেন ভারতীয় নভশ্চর শুভাংশু শুক্লা (Shubhanshu Shukla Returns)। তাঁর সঙ্গে থাকবেন নাসার ‘অ্যাক্সিয়ম-৪’ অভিযানের আরও তিন সহযাত্রী। ভারতীয় সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার দুপুর ৩টা ১ মিনিটে প্রশান্ত মহাসাগরে ‘ড্রাগন’ মহাকাশযানের স্প্ল্যাশডাউন হওয়ার কথা (Shubhanshu Shukla Returns)।
তবে পৃথিবীতে ফিরে এলেই সব শেষ—তা নয়। শুভাংশু ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য অপেক্ষা করছে এক দীর্ঘ পরবর্তী প্রক্রিয়া। শারীরিক পরীক্ষা, ডি-ব্রিফিং থেকে শুরু করে একাধিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রোটোকল মেনে চলতে হবে তাঁদের। আপাতত নাসার অন্দরে চলছে সেই প্রস্তুতিই।
গত ২৫ জুন স্পেসএক্সের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযানে চড়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) উদ্দেশ্যে রওনা দেন শুভাংশু শুক্ল এবং অ্যাক্সিয়ম-৪ অভিযানের আরও তিন নভশ্চর—ক্রু কমান্ডার পেগি হুইটসন, মিশন বিশেষজ্ঞ স্লাওস উজানস্কি-উইজ়নিউস্কি এবং টিবর কাপু। মহাকাশে টানা ১৮ দিন কাটানোর পর সোমবার শুরু হয়েছে তাঁদের পৃথিবীর পথে ফেরার যাত্রা।
প্রথমে নির্ধারিত সময়ের তুলনায় কিছুটা দেরিতে, বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে (ভারতীয় সময়) মহাকাশকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাঁদের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযান এবং শুরু হয় পৃথিবীর দিকে পুনঃপ্রবেশ। তবে মিশনের মূল অংশ শেষ হলেও এখানেই তাঁদের কাজ থামে না। মহাকাশ থেকে ফিরে নভশ্চরদের জন্য অপেক্ষা করে দীর্ঘ একটি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে থাকার ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে ফের মানিয়ে নিতে সময় লাগে। তাই স্প্ল্যাশডাউনের পর পরবর্তী সাত দিন শুভাংশু এবং তাঁর সহযাত্রীদের বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে, শারীরিক ও মানসিক নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে তাঁদের।
অবতরণের পর কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে শুভাংশু শুক্লা এবং তাঁর সঙ্গীদের?
- ভারতীয় সময় অনুযায়ী দুপুর ৩টে ১ মিনিটে তাঁদের মহাকাশযান ‘ড্রাগন’ প্রশান্ত মহাসাগরে স্প্ল্যাশডাউন করবে।
- স্প্ল্যাশডাউনের পরপরই স্পেসএক্সের একটি উদ্ধারকারী দল দ্রুত পৌঁছে যাবে ক্যাপসুলের কাছে। সেখান থেকে ক্যাপসুলটি উদ্ধার করে তুলে আনা হবে একটি প্রস্তুত জাহাজে। ওই জাহাজ থেকেই একে একে বের করে আনা হবে নভশ্চরদের।
- ক্যাপসুল থেকে বেরোনোর পর, প্রথম ধাপে নভশ্চরদের প্রাথমিক মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হবে সেই জাহাজেই।
- প্রাথমিক পরীক্ষার পর তাঁদের একটি হেলিকপ্টারে করে তীরে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে আরও কয়েক দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষা অপেক্ষা করছে।
- বিশেষজ্ঞরা জানান, মহাকাশে দীর্ঘ সময় ধরে মাধ্যাকর্ষণহীন পরিবেশে থাকার ফলে শরীরের ‘ভেস্টিবুলার সিস্টেম’ বা ভারসাম্য রক্ষা করার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পৃথিবীতে ফিরে অনেক নভশ্চরেরই প্রথম কয়েক দিন হাঁটাচলায় অসুবিধা হয়—কখনও টলমল পায়ে চলা, কখনও আবার সোজা দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হয়। কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, অবতরণের পরপরই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সেই কারণেই শুভাংশু ও তাঁর সহযাত্রীদের শারীরিক অবস্থা খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখা হবে।
- সবশেষে, চার নভশ্চরকেই সাত দিনের জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। একজন ফ্লাইট সার্জনের তত্ত্বাবধানে এই সময়ে তাঁদের শরীরের নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং ধাপে ধাপে পৃথিবীর পরিবেশে তাঁদের শরীরকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করা হবে।
দীর্ঘ সময় মহাকাশে থাকলে মানবদেহে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
মানবদেহ প্রকৃতিগতভাবে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ নির্ভর পরিবেশে কাজ করার জন্য তৈরি। তাই মাধ্যাকর্ষণহীন বা ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটি’ পরিবেশে দীর্ঘদিন কাটালে শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। যদিও এগুলির বেশিরভাগই সাময়িক, তবু সেগুলি অবহেলা করার মতো নয়।
- মহাকাশের মাইক্রোগ্র্যাভিটি শরীরের তরল পদার্থ এবং রক্তচাপের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। মাধ্যাকর্ষণের অভাবে শরীরের তরল উপরের দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে, যার ফলে মস্তিষ্কে তরলের চাপ বেড়ে যায়। মুখমণ্ডল ফুলে ওঠে, চোখে চাপ পড়ে এবং শরীরের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় হেরফের ঘটে। এই অবস্থায় অনেক নভশ্চরেরই প্রথম কয়েক দিনে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা এবং অসুস্থতার উপসর্গ দেখা দেয়। একে বলা হয় ‘স্পেস সিকনেস’ বা মহাকাশজনিত অসুস্থতা।
- এছাড়া দীর্ঘ সময় মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় থাকার কারণে হাড়ের ঘনত্ব দ্রুত কমে যায়। হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে—যা কার্যত মহাকাশীয় অস্টিয়োপোরোসিসের মতো। এই কারণে মহাকাশে থাকা অবস্থায় নভশ্চরদের প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় ধরে শরীরচর্চা করতে হয়, যাতে পেশি ও হাড় সক্রিয় থাকে এবং ভেঙে না পড়ে।
এই সব কিছুর মোকাবিলা করতেই পৃথিবীতে ফেরার পর একাধিক মেডিক্যাল পরীক্ষার পাশাপাশি চলে নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ। নভশ্চরেরা যেন দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই হয় প্রধান লক্ষ্য।
- মহাকাশে দীর্ঘ সময় কাটালে চোখের উপরও পড়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব। চোখের মণির আকার বদলে যেতে পারে, রেটিনায় গঠনগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এছাড়াও চোখে রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়ার কারণে অনেক সময় দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায় বা দৃষ্টিবিভ্রান্তির সমস্যাও দেখা দেয় মহাকাশচারীদের মধ্যে।
- মহাকাশে মহাজাগতিক রশ্মি এবং ক্ষতিকর সৌর বিকিরণের সংস্পর্শে থাকতে হয় অনেক বেশি সময়। এর প্রভাব সরাসরি শরীরের কোষের উপর পড়ে, ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসারের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এই কারণে নভশ্চরদের শরীরে বিশেষ যন্ত্র—ডোসিমিটার—পরিয়ে রাখা হয়, যা পরিমাপ করে তাঁদের শরীর ঠিক কতটা ক্ষতিকর বিকিরণ শোষণ করছে। এর ভিত্তিতেই পরে চিকিৎসা বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।