ডিজিটাল ডেস্ক, ২৮ জুন : আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার একবছরও পেরোয়নি, তার আগেই আরেকবার নারকীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল রাজ্য—এবার দক্ষিণ কলকাতার কসবার সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে এক ছাত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগ। পার্থক্য শুধু, আরজি করের নির্যাতিতা জুনিয়র চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছিলেন, আর কসবায় আক্রান্ত ছাত্রী বেঁচে আছেন। কিন্তু দুই ঘটনার পর সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় কোনও ফারাক স্পষ্ট হচ্ছে না। বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং একাধিক অরাজনৈতিক সংগঠন মনে করছে, যেখানেই থেমেছিল আরজি কর-কাণ্ড ঘিরে নাগরিক আন্দোলন, সেখান থেকেই কসবার ঘটনা যেন আন্দোলনের নতুন মঞ্চ তৈরি করছে (Kasba Protest Civic Society)।
কসবাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুক্রবার থেকেই রাজপথে নেমে এসেছে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির। মূল ধারার দলগুলোর পাশাপাশি, ছোট ও নবীন রাজনৈতিক শক্তিরাও কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়েছে। জানা যাচ্ছে, আরও আন্দোলনের পরিকল্পনাও প্রস্তুত হচ্ছে। কসবার ঘটনাকে ঘিরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে প্রতিটি বিরোধী দল—তারা আইনসভায় থাকুক বা না-ই থাকুক—এই ইস্যুকে হাতিয়ার করে জনমানসে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পেতে চাইছে। এটা অবশ্য কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়, ঠিক যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের এই মুহূর্তে কিছুটা আত্মরক্ষামূলক মনোভাব গ্রহণ করাও অবাক করার মতো নয়।
কসবা ল কলেজে ছাত্রীর উপর গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ এখন শুধু রাজনৈতিক গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—শুক্রবার থেকেই একাধিক অরাজনৈতিক সংগঠনও রাস্তায় নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রবিবার বিকেলে কলেজের সামনেই এক বিশাল জমায়েতের ডাক দিয়েছে একটি সংগঠন, যার ধরন হবে আরজি কর ঘটনার পর হওয়া ‘রাতদখল’ কর্মসূচির অনুরূপ। আয়োজকদের সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত বার্তায় সেই স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। আরজি কর কাণ্ডে ‘রাতদখল’-এর অন্যতম মুখ রিমঝিম সিংহ সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, “অনেক হয়েছে—আবার সময় এসেছে কলকাতা শহরকে কাঁপিয়ে তোলার।” তাঁদের পোস্টার, স্লোগান ও বার্তায় এটা স্পষ্ট, কসবার ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁরা আরজি করের প্রতিবাদের ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। এখনো নিশ্চিত নয়, সাধারণ মানুষ এই প্রতিবাদে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবেন কি না। তবে অনেকেই মনে করছেন, অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পথে নামা আন্দোলনের বিস্তার এবং গভীরতা দুই-ই বাড়িয়ে তুলতে পারে।
কসবা ল কলেজের গণধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক তরজা তীব্র হয়ে উঠছে। পরিস্থিতির আঁচ বুঝে তৃণমূল কংগ্রেস ও তাদের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি দাবি করেছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে এখন আর সংগঠনের কোনও সম্পর্ক নেই। দক্ষিণ কলকাতা জেলা টিএমসিপির সভাপতি সার্থক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য—সবাই জানান, ২০২২ সালের পর থেকে মূল অভিযুক্ত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন। তাঁদের আরও দাবি, অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ পদক্ষেপ করেছে এবং বৃহস্পতিবার তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাউকে আড়াল করার কোনও চেষ্টা হয়নি, তাই এ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা অনুচিত। এদিকে, আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপি পাল্টা অভিযোগ তুলেছে—তাদের দাবি, অভিযুক্ত যুবক এখনও দক্ষিণ কলকাতা টিএমসিপির সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে রয়েছেন। অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গেও সংগঠনের যোগসূত্র রয়েছে। এই দাবি প্রমাণে বিজেপির তরফে একাধিক ছবি ও প্রমাণ শুক্রবার রাত থেকেই প্রকাশ্যে আনা শুরু হয়েছে। বিজেপির শীর্ষ নেতারা সরাসরি দাবি করছেন, ২০২৫ সালেও অভিযুক্ত ব্যক্তি টিএমসিপিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার পর যেভাবে গোটা রাজ্য এবং দেশের একাংশ নাগরিক সমাজ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। তবে যে দ্রুততায় সেই আন্দোলন তীব্রতা অর্জন করেছিল, ঠিক ততটাই হঠাৎ করে থেমেও গিয়েছিল। এখন কসবার গণধর্ষণের ঘটনায় বিরোধী দলগুলি একটি নতুন ‘রাজনৈতিক অক্সিজেন’ খুঁজে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা ভালভাবেই জানে—এই প্রতিবাদ যদি সাধারণ নাগরিকদের নিজস্ব তাগিদে রাজপথে নিয়ে না আসে, তাহলে আরজি করের সেই আন্দোলন কেবল ইতিহাসের পাতায়ই ‘একক ঘটনা’ হিসেবেই থেকে যাবে। তার তুলনায় আরেকটি উদাহরণ তৈরি হওয়া তখন হয়ে উঠবে দুঃসাধ্য।