ডিজিটাল ডেস্ক, ৬ মে: অভিবাসন নীতি, মদ্যপান ও মোটরগাড়ি—এই তিনটি ইস্যুকে কেন্দ্র করেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটেনের সঙ্গে ভারতের ‘মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি’ মাঝপথেই থমকে গিয়েছিল। বহু আলোচনার পরও জট কাটছিল না। ঋষি সুনাকের সময় সেই আলোচনায় নতুন করে গতি আসে এবং একটি সবুজ সংকেতও মেলে। অবশেষে কিয়ের স্টার্মারের নেতৃত্বে সেই জট খুলল, ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের বহুল প্রতীক্ষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নের পথে এগোল (India UK Trade Pact)।
জানা গেছে, আজ মঙ্গলবার ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এই চুক্তির ফলে দুই দেশের মধ্যে অধিকাংশ পণ্য ও পরিষেবার উপর থেকে শুল্ক সরিয়ে দেওয়া হবে। গত ২৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল লন্ডন সফরে যান, এবং ২৯ এপ্রিল দুই দেশ আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করতে চাইলেও শেষ মুহূর্তে সময় বাড়িয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয়। এমন সময়, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিশ্ব বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টি করেছে, তখন দিল্লি-লন্ডনের এই চুক্তিকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক্স হ্যান্ডেলে এই চুক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন, “বন্ধু প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মারের সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেয়েছি। এটি এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যা দু’দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ অবদানে সম্ভব হয়েছে। এই যুগান্তকারী চুক্তি আমাদের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও দৃঢ় করবে এবং বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নতুন দিগন্ত খুলবে। আমি প্রধানমন্ত্রী স্টার্মারকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছি এবং তাঁকে স্বাগত জানাতে মুখিয়ে আছি।”
দীর্ঘদিন ধরেই তিনটি মূল ইস্যুতে ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল—অ্যালকোহল ও মোটরগাড়ির উপর ভারতের আরোপিত আমদানি শুল্ক কমানো এবং কাজের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে ব্রিটেনে যাওয়া কর্মপ্রার্থীদের উপর নিয়ন্ত্রণ। অ্যালকোহল ও গাড়ির শুল্ক হ্রাসে কিছুটা নমনীয়তা দেখালেও, অভিবাসন ইস্যুতে ভারত প্রথম থেকেই কঠোর অবস্থানে ছিল। ২০২১ সালে বরিস জনসনের সময় নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হলেও, তাঁর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের আমলে এই জট কাটার কোনও সম্ভাবনা দেখা যায়নি।
বিশেষ করে, তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যান মন্তব্য করেছিলেন যে, এই চুক্তি স্বাক্ষর হলে ব্রিটেনে ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যেতে পারে। তাঁর এই মন্তব্য শুধু নয়াদিল্লিতেই নয়, ব্রিটেনের ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অবশেষে সেই বিতর্কের জেরে ব্রাভারম্যানকে পদত্যাগ করতে হয়। পরে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে না পারায় পদ ছাড়েন লিজ ট্রাসও।
২০২২ সালে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আবারও নতুন করে আশার আলো দেখা যায় ভারত-ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে। ২০২৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেন সুনাক, যা যথেষ্ট ইতিবাচক ফল দেয়। এরপর দু’দেশের মধ্যে চুক্তি নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চলতে থাকে।
তবে এরপর ব্রিটেনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে এবং কিয়ের স্টার্মারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি সরকার গঠন করে। স্টার্মারের বিদেশনীতি অনেকটাই ভারতমুখী এবং তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিকে অগ্রাধিকার দেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। অবশেষে, স্টার্মারের নেতৃত্বেই বহু প্রতীক্ষিত এই চুক্তির জট কাটল এবং চুক্তি স্বাক্ষরের পথে এগোল দুই দেশ।