Malda School:উধাও ‘ব্যাকবেঞ্চার’ বৈষম্য! “ইউ” ধাঁচে ক্লাসরুম মালদহের স্কুলে

11

ডিজিটাল ডেস্ক ১৭ই জুলাইঃ Malda School: ‘লাস্ট বেঞ্চে যারা বসো, তারা সামনে চলে এসো!’ অথবা, ‘অ্যাই, তুমি পিছনের বেঞ্চে চলে যাও!’ এই দুই বাক্য বহু প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের জীবনেই যেন নিত্যদিনের চেনা আওয়াজ হয়ে থেকে গেছে। কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। ফিকে হচ্ছে বৈষম্য। তাই এখন আর ক্লাসরুমে এমন বসার ব্যবস্থাই থাকছে না, যেখানে আলাদা করে ফারাক তৈরি করবে বসার বেঞ্চ। ‘লাস্ট বেঞ্চ’ বা ‘পিছনের বেঞ্চ’ বলে কিছু আর থাকবে না। তাই একটা ক্লাসে কেউই ‘ব্যাকবেঞ্চার’ বা ‘লাস্টবেঞ্চার’ হিসেবে চিহ্নিত হবে না! এদিন বাংলার একটি স্কুলের শ্রেণিকক্ষে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ইউ(Malda School) আকৃতির বসার ব্যবস্থা।

ঠিক যখন বিভিন্ন সময়ে বারবার সরকারি স্কুলগুলির বেহাল দশা সামনে আসছে বারংবার । পরিকাঠামো থেকে শুরু করে পঠন পাঠন ব্যবস্থায় ঢিলেমি লক্ষ্য করা যাচ্ছে । তখন ব্যতিক্রম মালদহ জেলার পুরাতন মালদহের কাদিরপুর কিরণময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিছুদিন আগে মালদা শহরের ঐতিহ্যবাহী বার্লো গার্লস হাইস্কুলে নো ওয়ান ব্যাকবেঞ্চার্স পদ্ধতি চালু করা খবরের শিরোনামে আসে। তখন এই স্কুল নিঃশব্দে জেলার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে আগেই এই পদ্ধতি চালু করেছিল। যা এখনো চলছে। এখানে কেউ ব্যাকবেঞ্চার্স নয়। অর্থাৎ পড়ুয়াদের মধ্যে থাকবে না কোন ভেদাভেদ। সবাই বসে ফার্স্ট বেঞ্চে। কেউ পেছনের সারিতে থাকে না। কেউ অবহেলিত হয় না। শ্রেণিকক্ষে বেঞ্চ সাজানো থাকে ইংরেজি ইউ এর মত করে। ফলে সামনের বেঞ্চ বা পেছনের বেঞ্চ কোন ব্যাপার থাকে না।

শিক্ষকদের মতে পড়ুয়াদের মনে অনেক সময় সামনের বেঞ্চ পেছনের বেঞ্চ নিয়ে একটা বিভেদের ধারণা থাকে। যে পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করলেই সে সামনের বেঞ্চে বসবে। যারা করতে পারবে না তারা পেছনের বেঞ্চে। এই ধারণা যাতে না তৈরি হয়। সকলেই সমান এই ভাবনা যাতে পড়ুয়াদের মনে থাকে। তাই এই উদ্যোগ। তবে সমস্যা রয়েছে কিছুটা। কারণ এই মডেলের জন্য শ্রেণিকক্ষ বড় দরকার। বড় ঘরের অভাবে এই মডেল চালিয়ে যাওয়া সমস্যার হচ্ছে। এছাড়াও এই স্কুলের শ্রেণিকক্ষের দেওয়ালে জাতীয় পতাকা দেশের ম্যাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাণী এবং পড়াশোনার বিভিন্ন জিনিস সুন্দর ভাবে আঁকা রয়েছে। যা শিশু মনে খুব ভালো প্রভাব ফেলবে। এক কথায় পড়াশোনার আদর্শ পরিবেশ।

আগেই কেরল, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাবে এমনটা আগেই হয়েছিল। এবার সেই তিন রাজ্যের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গের মালদহেও চালু হয়েছে ‘নো মোর ব্যাক বেঞ্চার’ মডেল। জেলার শতাব্দীপ্রাচীন বার্লো গার্লস হাই স্কুলে পরীক্ষামূলকভাবে একটি শ্রেণিকক্ষ সাজানো হয়েছে ইউ-আকৃতিতে।

মালদহের ইংলিশবাজারে অবস্থিত বার্লো গার্লস হাই স্কুলে প্রায় ১৯০০ ছাত্রী পড়ে। শনিবার সপ্তম শ্রেণির একটি শ্রেণিকক্ষে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ইউ আকৃতির বসার ব্যবস্থা। উপস্থিত ছিলেন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক বাণীব্রত দাস। তিনি বলেন, ‘ফার্স্ট বেঞ্চার ও লাস্ট বেঞ্চার এই চিরকালীন বিভাজনের অবসান ঘটাতে চাইছি আমরা। এখন যে কনফিগারেশনে বসানো হচ্ছে, তাতে সকলেই শিক্ষকের সামনে থাকবে। কেউ পিছিয়ে থাকবে না।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা দীপশ্রী মজুমদার জানান, ‘ব্যাক বেঞ্চার বলতে অনেকের মনে পড়ে যায় অলস, অনাগ্রহী ছাত্রছাত্রীর ছবি। কিন্তু এই নতুন সাজানোতে পিছনের আসন বলে কিছুই থাকবে না। সবাই সামনে, সবাই শিক্ষকের চোখে দৃশ্যমান। এই ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ ও অংশগ্রহণ বাড়াবে।’

দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনে এমন পরিবর্তন দেখে অভিভূত সব শিক্ষকই। যেমন কেরলের রামবিলাসম স্কুলের এক শিক্ষিকা বলেছেন, ‘বাচ্চারা আগের চেয়ে বেশি চোখে চোখ রাখছে, বেশি প্রশ্ন করছে। আগে যারা চুপচাপ থাকত, তারাও এখন কথা বলছে।’

বার্লো গার্লস স্কুলের এক অভিভাবক ময়ূক সরকার বলেন, ‘পিছনের বেঞ্চে বসলে অনেক সময় শিক্ষকের নজর কম পড়ে। নতুন এই ব্যবস্থা সব ছাত্রীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করবে।’

শুধু শিক্ষক বা অভিভাবকরা নন, এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা বেড়েছে সরকারি স্তরেও। তামিলনাড়ু সরকারের এক শিক্ষা আধিকারিক বলেন, ‘এই ধরনের শ্রেণিকক্ষের জন্য আলাদা পরিকাঠামোর দরকার পড়ে না। শুধু ভাবনার বদলই যথেষ্ট।’

একই সুর শোনা গিয়েছে পাঞ্জাবেও। সেখানে একটি স্কুলে ওই সিনেমাটি দেখানোর পরে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেরাই ক্লাসরুমের সজ্জা বদলে দেন। এই উদ্যোগকে কেউ বলছেন যুগান্তকারী, কেউ দেখছেন মজার ছলে। প্রাক্তন সিবিআই আধিকারিক ভিভি লক্ষ্মী নারায়ণ এক্সে লেখেন, ‘একটি সরল পরিবর্তন কীভাবে সাম্য ও আত্মবিশ্বাসে এত প্রভাব ফেলে, তার বড় উদাহরণ।’

এই নিয়ে শিল্পপতি হর্ষ গোয়েঙ্কা রসিকতা করে লেখেন, ‘ভালই হয়েছে আমি কেরলে পড়িনি! আমার সামোসা, আঁকাবাঁকা নোট আর টিফিনের ঘুম কোথায় যেত!’

সব মিলিয়ে, ক্লাসরুম এখন আর সামনের ও পিছনের ভাগে বিভক্ত নয়। ইউ আকৃতির বসার ধরন শুধু আসনের রদবদল নয়, এটি এক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। শিক্ষার ক্ষেত্রে এ যেন নতুন এক ইনক্লুসিভ যুগের সূচনা, যেখানে সবাই শিক্ষকের চোখের সামনে থাকবে, সবাই আলোচনার অংশ হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেউই পিছিয়ে থাকবে না।