International Drug Mafia Arrested : তিন মহাদেশে ছড়িয়ে মাদক-সাম্রাজ্য! ফিল্মি কায়দায় পাকিস্তানের ড্রাগ মাফিয়া মার্কিন পুলিশের ফাঁদে

14

ডিজিটাল ডেস্ক, ১৬ জুন : সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী পরিচয়ের আড়ালে কোটি কোটি টাকার মাদকের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। আদালতের রায়ে কঠোর শাস্তি হয়েছে, যার ফলে তাঁকে বাকি জীবন জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে কাটাতে হবে। এক সময় ‘সুলতান’ নাম পাওয়া এই কুখ্যাত মাফিয়া এখন অপরাধের কারণে পথের ভিখারি হয়ে গিয়েছেন। এছাড়া, তাঁর নাম সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া পাকিস্তানের সঙ্গে জড়িত বলেও জানা গেছে (International Drug Mafia Arrested)।

আন্তর্জাতিক মাদক পাচারচক্রের অন্যতম বড় নাম আসিফ হাফিজ, যাকে অপরাধ জগতের লোকেরা ‘সুলতান’ নামে চেনেন। তাঁর মাদক সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বিস্ময়কর—আফগানিস্তানের আফিম খেত থেকে শুরু করে ইউরোপ ও আফ্রিকা হয়ে তা পৌঁছে যেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত। শেষপর্যন্ত, আমেরিকার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, এবং চলতি বছরে আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর শাস্তি দিয়েছে।

নিউ ইয়র্কের কারাগারে বন্দি রয়েছেন আসিফ হাফিজ়, যিনি ‘সুলতান’ নামে পরিচিত। গত ৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের আদালত তাঁকে ১৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে। তবে এই কঠোর শাস্তি শুনে অনেক আমেরিকাবাসী বিস্মিত হয়েছেন। তাঁদের মতে, হাফিজ় একজন সজ্জন ও পরোপকারী ব্যক্তি, এবং তাঁকে মাদক পাচার চক্রের ‘কিং পিন’ হিসেবে মানতে অনেকেই অস্বীকার করেছেন। এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়, কারণ আটলান্টিকের ওপারে দ্বীপরাষ্ট্রের অভিজাত মহলে তাঁর অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল।

মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, লন্ডনে থাকাকালীন আসিফ হাফিজ় মাদক পাচারচক্রে যুক্ত হন। তিনি নিয়মিত এক পোলো ক্লাবে যাতায়াত করতেন, যেখানে ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সদস্যরা আসতেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা তাঁকে ব্রিটেনের উচ্চবিত্ত মহলের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ দেয়। এরপর, তাঁদের আড়ালে থেকে তিনি ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া ও পাকিস্তানে মাদক পাচার শুরু করেন।

লন্ডন পুলিশের নজর এড়াতে আসিফ হাফিজ় নিজেকে বিত্তবান ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু রাত নামলেই তাঁর গ্যাং মাদক চোরাচালানে সক্রিয় হয়ে উঠত। হেরোইন, কোকেনের পাশাপাশি সিন্থেটিক মাদক, মেথামফেটামিন ও হাসিসের পাচার করতেন তিনি। তাঁর ক্রেতাদের মধ্যে কলেজ পড়ুয়া, চাকরিজীবী, খেলোয়াড় ও শ্রমিক—সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ছিল। বিশেষত ইউরোপের রেভ পার্টিগুলিতে তাঁর গ্যাংয়ের সরবরাহ করা হেরোইনের চাহিদা ছিল সর্বদা তুঙ্গে।

পাকিস্তানের নাগরিক আসিফ হাফিজ়ের মাদক পাচারচক্রের উত্থান যেন এক রোমাঞ্চকর হলিউড থ্রিলারের চিত্রনাট্য। ১৯৫৮ সালে পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরে জন্ম নেওয়া হাফিজ় ছোটবেলা থেকেই অর্থ উপার্জনের প্রতি প্রবল আকৃষ্ট ছিলেন। ৯০-এর দশকের গোড়ায় তিনি ‘সারওয়ানি ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যা মূলত মাদক পাচারের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করতেন। ‘সুলতান’ নামে পরিচিত এই মাফিয়া তাঁর সংস্থাকে মাদক পাচারের বৈশ্বিক দুনিয়ায় দাবার বোড়ে হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

সংবাদ সংস্থা বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রথমে ‘সারওয়ানি ইন্টারন্যাশনাল’কে একটি সাধারণ বৈধ প্রতিষ্ঠান মনে করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে হাফিজ় সেনা সরঞ্জাম ও কাপড় বিক্রি করতেন, পাশাপাশি লাহৌরে একটি রেস্তোরাঁ পরিচালনা করতেন। এই ব্যবসার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের উচ্চবিত্তদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর বিশাল মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘সুলতান’ এই সম্পর্কগুলিকে সুচারুভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন।

পাকিস্তান থেকে হাফিজ় ঠিক কখন ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আসেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত হ্যাম পোলো ক্লাবের অন্যতম কর্তা হয়ে ওঠেন। এর ফলে আটলান্টিকের দ্বীপরাষ্ট্রের অভিজাত মহলে তাঁর পরিচিতি গড়ে তুলতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, ‘সুলতান’ প্রথম থেকেই ক্লাবটির সদস্য ছিলেন না।

গোয়েন্দাদের মতে, পাকিস্তানের গোপন ঘাঁটি থেকে আসিফ হাফিজ হেরোইন, হাসিস ও মেথের মতো ভয়ঙ্কর নেশার দ্রব্য ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করতেন। নিজেকে আড়াল রাখতে তিনি ব্রিটেন এবং পশ্চিম এশিয়ার পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। কখনও কখনও তিনি তাঁদের কাছে পাচারের তথ্য সরবরাহ করতেন, যার ফলে কিছু মাদক উদ্ধার সম্ভব হলেও মূল পাচারের কার্যক্রম অব্যাহত থাকত। এভাবেই তিনি দীর্ঘদিন সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে সক্ষম হন।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (ডিইএ) একটি স্টিং অপারেশন চালিয়ে ‘সুলতান’ আসিফ হাফিজ়ের অপরাধ সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করে। মাদক পাচার বন্ধ করতে ডিইএর কর্মকর্তা তাঁর গ্যাংয়ে এজেন্টদের প্রবেশ করান। এজেন্টদের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনের রেকর্ডিং গোয়েন্দাদের হাতে আসে, যা তাদের চমকে দেয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন ডিইএ বুঝতে পারে, ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাফিজ় আসলে এক ভয়ঙ্কর অপরাধী।

গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় মাদক সরবরাহের পরিকল্পনা করতে কলম্বিয়ার পাচারকারীদের সঙ্গে কেনিয়ার মোম্বাসায় বৈঠক করেন ‘সুলতান’ গ‌্যাংয়ের দুই সদস্য। ওই কথোপকথনের রেকর্ডিং ফাঁস হওয়ার পর ডিইএ অফিসাররা পুরো বিষয়টি বুঝতে পারেন। সে বছর হাফিজ় ৯৯ কেজি হেরোইন ও ২ কেজি মেথ পাচারের পরিকল্পনা করেছিলেন। এরপর মার্কিন পুলিশ তাঁর দলের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে এবং বিপুল পরিমাণ মাদক ও পাচারের সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

সুলতানের গ্যাংয়ের সদস্যদের জেরা করতে গিয়ে গোয়েন্দারা বুঝতে পারেন যে পাচারচক্রের বিস্তৃতি কতটা গভীর। ২০১৬ সালে হাফিজ়ের পাশাপাশি বিজয়গিরি ওরফে ভিকি গোস্বামীর নামও পুলিশের নজরে আসে। তিনি মেথামফেটামিনের বিস্তৃত উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দু’জনে মিলে মোজ়াম্বিকে ১৮ টন এফিড্রিন চালান করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তবে তা কেনিয়া পৌঁছানোর আগেই গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে মাদক আটকে দেন।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন পুলিশ আসিফ হাফিজ়কে গ্রেফতার করে, পালিয়ে বাঁচার আর কোনও পথ ছিল না তাঁর। যুক্তরাষ্ট্র তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রত্যর্পণের দাবি জানায়, তবে হাফিজ় ব্রিটেনের আদালতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয়, এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়।

প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত শুনানির সময় হাফিজ়ের আইনজীবী যুক্তি দেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলে তাঁর মক্কলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এছাড়া, মধুমেহ ও হাঁপানি থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি শাস্তি এড়ানোর চেষ্টা করেন। তবে ব্রিটেনের আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে, যার পর মামলাটি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে গড়ায়। অবশেষে ২০২৩ সালে ওই আদালতের বিচারপতিরা তাঁকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

২০২৪ সালে নিউ ইয়র্কের আদালত আসিফ হাফিজ়কে মাদক পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। আমেরিকান আইনজীবীরা তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও মাদক পাচারের গোপন কার্যকলাপের মধ্যে স্পষ্ট অসঙ্গতি তুলে ধরেন। আদালতে তাঁদের যুক্তি ছিল, হাফিজ় দারিদ্র্যের কারণে অপরাধের পথে যাননি; বরং তিনি ছিলেন লোভী ও ক্ষমতালিপ্সু, যা তাঁকে এই অন্ধকার জগতে টেনে এনেছে।

২০৩৩ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্কের জেলে বন্দি থাকবেন আসিফ হাফিজ়। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, তাঁর গ্যাংয়ের অধিকাংশ সদস্য ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে। জানা গেছে, ‘সুলতান’-এর মাদক পাচার থেকে অর্জিত অর্থ সন্ত্রাসবাদে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।